আমার প্রেমের গল্পগুলো সহজ-সরল একরৈখিত, খুব একটা আকর্ষণীয় নয় আর এর ভেতরে রগরগে বিষয় এবং এডভেঞ্চার না থাকায় অনেকের কাছে ম্যাড়মেড়েও মনে হতে পারে... অগ্রীম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
আমার প্রথম প্রেমটা ছিল মায়ের দুধের সাথে।অন্য ছেলে-মেয়েরা যে বয়সে মায়ের বুকের দুধ খাওয়া ছাড়ে আমি তার অনেক পরেও নির্লজ্জের মতো বকা-ঝকা উপেক্ষা করেই মায়ের বুকের দুধ খাওয়া চালিয়ে গেছি। মায়ের দুধ খাওয়ার স্মুতিটা পরিণত বয়সে কারো মনে থাকার কথা নয় কিন্তু আমার স্মৃতিতে এখনো ছেড়াখোড়া ভাবে এ সংক্রান্ত কিছু স্মৃতি থেকেই গেছে। হতে পারে যে বয়সে আমি মায়ের দুধ খাওয়া বন্ধ করেছি (৪/৫ বছর বয়সে) সে বয়সের স্মৃতিগুলো মানুষ স্মরণ করতে পারে বলেই এইটা সম্ভব হয়েছে।
আমার পরের প্রেমটা ছিল গুলটি এবং মাটির গুলির সাথে (যতদুর মনে করতে পারি)। গুলটিকে আমরা বাটুল নামে চিনতাম। একটা বয়স পর্যন্ত আমি এবং আমরা ওয়াই সেপের গাছের ডাল কেটে তার সাথে গাড়ির চাকার টিউব (ইলাষ্টিক নামে ডাকতাম) লাগিয়ে গুলতি বানাতাম। এই ইলাষ্টিকটা আমরা বড়োদের গুলতি ছিড়ে গেলেই শুধুমাত্র পেতাম। গুলতি যদিও দোকানে কিনতে পাওয়া যেত - সেইগুলো ছিল মসৃণ কাঠের সাথে চামড়া দিয়ে বাইসাইকেলের ভালটিউব জুড়ে বানানো (আমার মনে হয় আপনারা শুধুমাত্র এই পদের গুলতিই চেনেন), কিন্তু সেগুলো কেনার চিন্তা আমরা জেগে থেকে কখনোই করতে পারতাম না। এই রকম একটা কেনা গুলতির মালিক হওয়ার কথা কেবল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নে মধ্যেই ভাবতে পারতাম। আমার মেজো মামা ছিল খুব শৈখিন শিকারী। তার মালিকানায় তিনটা দারুণ দারুণ গুলতি ছিল। সে সেগুলোকে আলাদা আলাদা তিনটা নামে ডাকতো এবং নিয়মিত পালিশ করে চকচকে করে রাখতো। শিকারের দিন তার সাথে ঘুরে তার ফাই-ফরমায়েস খেটে দিলে সে খুশি হয়ে কখনো কখনো তার গুলতি আমাদের নাড়তে দিতো (মারতে দিতো না)। সেইটাই তখন আমার এবং ছোট মামার কাছে পরম ভাগ্য বলে মনে হতো। তো মেজো মামা যখন শিকার করতে বের হতো - আমি আর ছোট মামা সারা দিন তার পেছনে পেছনে ঘুরতাম। মেজোমামা এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরী মসৃণ গুলি দিয়ে পাখী মারতো আর আমরা দুইজন আমাদের হাতে বানানো গুলতিতে মাটির টুকরা ভরে হুদাই এদিক ওদিকে কাল্পনিক পাখী কে এইম করে গুলি ছুড়তাম। মেজো মামার গুলিতে কোন পাখী ঘায়েল হলে আমরা দৌরে গিয়ে কুড়িয়ে আনতাম। মামা তার পাখী জবাইয়ের ছুরি দিয়ে সেইগুলা জবাই করতো (শিকার করা পাখী জবাই করার জন্যে তার আলাদা একটা চাকু ছিল, যেটা সে শুধুমাত্র শিকারের দিনই নিয়ে বের হতো)। তার এইম ছিল অসাধারণ। দুই তিনটা গুলি খরচ করেই সে একটা পাখী মারতে পারতো। মেজো মামার বানানো গুলি ছিল গ্রামের মধ্যে বিখ্যাত। গ্রামের কোন ছেলেই তার মতো মসৃণ শক্ত গুলি বানাতে পারতো না। প্রতি সপ্তাহেই দু'য়েক দিন সে গুলি বানাতে বসতো। এর জন্যে সে নদীর তলে থেকে স্পেশাল এঁটেল মাটি তুলে আনতো। যে দিন সে গুলি বানাতো সেই দিন একটা বিরাট আয়োজন হতো। মাটি ছেনে হাতের তালুতে নিয়ে মূহুর্তেই কি সুন্দর চমৎকার সুনিপুণ গোল গোল গুলি তৈরী করে ফেলতো - সেইটা তার গুণ মুগ্ধ ভাগ্নে হিসাবে আমি এবং আমার ছোট মামা অবাক হয়ে দেখতাম। এর পরে এই গুলি রোদে শুকানো হলে লোহার মতো শক্ত গুলি তৈরী হয়ে যেত। পরবর্তীতে অবশ্য মেজো মামার চেয়ে ছোট মামার তৈরী মাটির গুলিই গ্রামে বেশি বিখ্যাত হয়েছিল - আরো শক্ত এবং সুন্দর হওয়ায়। সেইটা আরেক গল্প, যেখানে মাটির গুলি আরো শক্ত করার উপায় উদ্ভাবনে আমিও ছিলাম ছোট মামার সঙ্গী। আমার আর ছোট মামার কাজ ছিল তৈরী হওয়া গুলি গুণে (স্কুলে যাওয়ার আগেই আমি ১০০ পর্যন্ত গুনতে পাতাম) শুকাতে দেয়া এবং দেখে রাখা যেন কেউ চুরি করতে না পারে। বিনিময়ে খুশি হয়ে মেজো মামা তার রিজেক্টেড গুলিগুলো আমাদের মধ্যে ভাগ করে দিতো এবং শিকার করতে গেলে আমাদের সঙ্গে নিতো।
যে বছর আমি ইসকুলে ভর্তি হলাম, সেই বছর নানার বাড়িতে বেড়াতে আসলে মেজো মামা তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় গুলতির কালেকশান থেকে কালাচাঁন নামের গুলতিটা আমাকে উপহার দিয়েছিল। সেইটাকে তেল মালিশ করতে করতে কালচে রং ধারণ করে ছিল অথবা কাঠের কারণেই কালো ছিল বলে আদর করে কালাচান বলে ডাকতো। এই গুলতির ইলাষ্টিক ছিল ভালব-টিউব দিয়ে তৈরী (ছেড়া নয় কিন্তু)। আহ্ সে দিন যে আমার কি অনুভূতি হয়েছিল তা আজ আর অনুভব করা বা আপনাদের বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
তো পরের কয়েকটা বছর এই গুলতিটা ছিল আমার জানের জান, প্রানের প্রাণ, সার্বক্ষণিক সঙ্গি। ঘুমানোর সময় কি পড়তে বসে এমন কি বাথরুম করতে বসেও এইটা আমার গলায় ঝোলানো থাকতো । শত বকাবকি কি মারধোর করেও কেউ এই গুলতিটা থেকে আমাকে অথবা আমার কাছ থেকে গুলতিটাকে আলাদা করতে পারতো না। আমি সারাদিন ছোট মামার সঙ্গে টৈ টৈ করে কালাচান কে সাথে নিয়ে শিকার করে বেড়াতাম (যদিও সফল শিকার করতে পারতাম কদাচিত)। ততোদিনে ছোট মামাও কোথা থেকে যেন একটা দোকান থেকে কেনা পুরাতন গুলতি জোগাড় করে ফেলেছিল এবং ততোদিনে আমি আর ছোট মামা মিলে নিজেরাই এঁটেল মাটি দিয়ে গুলি তৈরী করা রপ্ত করে ফেলেছিলাম, যদিও সেগুলো তখনো খুব একটা গোল এবং মসৃণ হতো না বা মেজো মামার তৈরী গুলির মতো চকচক করতো না বা ততো শক্তও হতো না।
গুলতি এবং মাটির গুলির সাথে আমার এই প্রেমটাই ছিল আমার জীবনের উল্লেখযোগ্য প্রথম প্রেম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন